বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে গত দুই দিন বৃষ্টি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায়। বেশিরভাগ নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে উপকূলীয় কয়েকটি জেলার নিচু এলাকা। অতিরিক্ত পানির স্রোতে ভাঙন দেখা দিয়েছে শরীয়তপুরের মাঝিরঘাট এলাকার পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাঁধে।
রেকর্ড বৃষ্টিতে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি ও বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অনেক এলাকা। এছাড়া টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা তৈরী হয়েছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় আরো অন্তত ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। সমুদ্র কিছুটা উত্তাল থাকায় বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখানো হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, সারাদেশে টানা বৃষ্টিতে দেশের প্রায় সব নদনদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে উজানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় এখনো স্থায়ী বন্যার শঙ্কা নেই।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এই আকস্মিক বন্যায় ফেনীর দুই উপজেলার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া জেলার তিনটি নদীর তীর রক্ষা বাঁধের অন্তত ১৭টি পয়েন্টে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে পদ্মা সেতুর কাছাকাছি শরীয়তপুরের মাঝিরঘাট এলাকায় পদ্মা নদীর ভাটিতে হঠাৎ ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ। এতে বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ২০টি স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মা সেতু থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নদীর তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। “এর সাথে পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধের কোনো সম্পর্ক নেই।”
ফেনীতে হঠাৎ বন্যা, খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা
কোমর সমান পানিতে তলিয়েছে ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক। ভারী বৃষ্টিতে ডুবেছে শহরের বিভিন্ন এলাকা। পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ রাখা হয়েছে শহরের একাডেমী এলাকার হোটেল, রেস্তোরা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা। একটানা ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত নগরীর বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনজীবীকা।
জানা গেছে, রেকর্ড বৃষ্টিতে পরশুরামের বল্লামুখা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বাঁধ ভেঙে ফুলগাজির ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ফেনী জেলার অন্তত ১৭টি স্থানের শহর ও নদীর তীর রক্ষা বাঁধ কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর পানি বাড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থান ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ফেনীতে গত আটই জুলাই ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ওই দিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় ২০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। নয়ই জুলাই ৩৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ডের খবর জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বুধবারের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর পানি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়।
হঠাৎ পানি বৃদ্ধি এবং ১৭টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার নিচু এলাকা। জলাবদ্ধ হয় ফেনীর মূল শহরের বেশিরভাগ সড়কও।
২০২৪ সালেও বন্যার কবলে পড়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। সেবারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এবছর আবারো সেই শঙ্কায় ফেনীর স্থানীয় বাসিন্দারা।
তারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার পানি আরো বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।”অনেক তাড়াতাড়ি পানি উপরের দিকে উঠতেছে শুধু,” বলছিলেন একজন বাসিন্দা।
“আমরা ত্রাণ চাইনা, আমরা বেড়িবাঁধটা নির্মাণ চাই, মুহুরী নদী খনন চাই,” বলেন ফুলগাজী উপজেলার এক বাসিন্দা।
ফুলগাজীর নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম জানান, সাতটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৩২টি মাধ্যমিক স্কুল এবং ৬৭টি প্রাথমিক স্কুলে সাহায্য কেন্দ্র হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে। যেখানে বুধবার দুপুর পর্যন্ত চারশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
“তাদের জন্য খাবার ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। ঝুঁকি এড়াতে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ সাময়িক বন্ধ রেখেছে জেলা প্রশাসন,” জানান মিজ ইসলাম।
এদিকে, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে। গত ২৪ ঘন্টায় জেলাটিতে ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মাইনী নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে মেরুংয়ের নিচু এলাকা। মেরুংয়ে হেডকোয়ার্টার এলাকায় সড়কে পানি ঢুকে খাগড়াছড়ি-লংগদু সড়কে যান চলাচল বন্ধ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে মাইনী ও চেঙ্গী নদীর পানির আরো বেড়ে নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া পাহাড় ধসের শঙ্কায় রয়েছে সাড়ে তিন হাজার পরিবার।
পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে প্রচারণা চালাচ্ছে খাগড়াছড়ি উপজেলা প্রশাসন।
পদ্মা সেতুর ভাটিতে নদীর তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন?
সামাজিক মাধ্যমে মঙ্গলবার ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর কাছাকাছি জাজিরা অংশের মাঝিরঘাটে নদীতে বিলীন হচ্ছে কয়েকটি স্থাপনা।
ভিডিওটিতে অনেকে দাবি করেন পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যদিও এই দাবি নাকোচ করেছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস। তিনি জানান, “সংবাদটি অনেকেই মিসলিডিং (ভুলভাবে প্রচার) করেছেন।”
পদ্মা সেতু থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভাটিতে নদীর তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। “ওই এলাকায় ওয়াটার বোর্ড (পানি উন্নয়ন বোর্ড) নদীর তীর রক্ষায় একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছে,” বলেও জানান মি. ফিরদাউস।
তিনি বলেন, শরিয়তপুরের পদ্মা নদী তীরবর্তী ওই এলাকা এমনিতেই ভাঙনপ্রবণ। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় ২০১২ সালের দিকে ওই এলাকার বাসিন্দাদের নদী ভাঙন থেকে বাঁচাতে এবং কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষা করার জন্য অস্থায়ী বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
“এটি পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধের কোনো অংশ নয়,” বলেও জানান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী।
ভাঙন কবলিত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সোমবার বিকেলে মাত্র দুই ঘণ্টার ভাঙনে অন্তত ১০টি বসতবাড়ি ও ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরও অন্তত ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তারা।
স্থানীয়রা দাবি করেন, মাঝিরঘাট অংশে বাঁধে ফাটল ধরার বিষয়টি এর আগে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। “বালুর বস্তা ফেলে কিছু মেরামত করা হইছিল,” বলেন ভাঙন কবলিত ওই এলাকার একজন বাসিন্দা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বাঁধটির ওই অংশের প্রায় ১৫০ মিটার পুরোপুরে ধ্বসে গেছে।
শরীয়তপুরের মাঝিরঘাটে ভাঙন কবলিত এলাকা
শরিয়তপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারেক হাসান বিবিসি বাংলাকে জানান, “পানি বৃদ্ধি পাওয়াই পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের কারণেই ভাঙনটা হয়েছে। মাটির ফাউন্ডেশন খারাপ হওয়ায় ভেঙে গেছে। তবে ওই দিন থেকে আমরা কাজ শুরু করায় নতুন করে আর ভাঙন হয়নি,” জানান মি. হাসান।
বাঁধের এই অংশে আগেও প্রায় ২০০ মিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছিল যা মেরামত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে আর নতুন করে ফাটল ধরেনি বলেও জানান তিনি।
“মূলত এই কাজটা আমরা করি নাই, পদ্মা সেতুর ইয়ার্ড কন্সট্রাকশনের জন্য প্রকল্পের আওতায় এই কাজটি করা, যেহেতু এখন ভেঙে গেছে আমরা এখন কাজটা টেক ওভার করেছি,” বিবিসি বাংলাকে জানান মি. হাসান।
পদ্মা নদীর তীর রক্ষা বাঁধের প্রায় আড়াই কিলোমিটারের এই এলাকায় নতুন একটি প্রকল্প দিয়ে আবারো স্থায়ীভাবে কাজটি করার পরিকল্পনার কথাও জানান পানি উন্নয়ন বিভাগের এই কর্মকর্তা।
এর আগেও পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের প্রায় ২০০ মিটার অংশ ধসে পড়েছিল পদ্মা নদীতে। যাতে হুমকিতে পড়েন জাজিরা উপজেলার তিনটি গ্রামের অন্তত ৬০০ পরিবার।
গত ১১ই জুন ভাঙনকবলিত ওই এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন অর্থ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
টানা বৃষ্টি কতদিন চলবে, বন্যার শঙ্কা কতটা?
সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সারাদেশেরই কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে। ভারী বৃষ্টির কারণে ফেনীতে এরই মধ্যে আংশিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বাঁধ ভেঙে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, জলাবদ্ধ জেলা শহরও।
আবহাওয়ার সবশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৩৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। রংপুর বিভাগ ছাড়া অন্য সব বিভাগেও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং এর কাছাকাছি এলাকায় একটি লঘুচাপ অবস্থান করছে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় থাকায় সারাদেশেই কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে রংপুর. রাজশাহী ও ময়মনসিংহ সহ অন্যান্য বিভাগেও।
আবহাওয়াবিদ তরিকুল নেওয়াজ কবির বলছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক জায়গায় কমে আসতে পারে। তবে “জুলাই মাস সব থেকে বৃষ্টি প্রবণ হওয়ায় একেবারে যে বৃষ্টি বন্ধ হবে এটা বলা যায় না,” বলেন মি. কবির।
“টানা বৃষ্টিতে দেশের বেশিরভাগ নদনদীর পানিই কিছুটা বাড়লেও এখনই স্থায়ী বন্যার শঙ্কা নেই” বলেই জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, ফেনীতে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি আরো ২৪ ঘণ্টা স্থিতিশীল থেকে উন্নতির দিকে যাবে।
চট্টগ্রামের হালদা নদীর পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া দেশের বেশিরভাগ নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে, জানান রায়হান।
গঙ্গা অববাহিকায় পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশের উজানে ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারাসহ সব নদনদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। ভারতের ত্রিপুরাতেও এখন পানি বৃদ্ধির তেমন কোনো শঙ্কা নেই বলেই জানান রায়হান।