ঢাকা ০৮:০৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যে প্রকৌশলী ফাঁস করেছিলেন ইসরায়েলি পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য

মোরেখাই ভানূনু

“ইরানের অস্ত্র তৈরির একেবারে কেন্দ্রস্থলে আমরা আঘাত হেনেছি,” ইসরায়েল যখন গত সপ্তাহে ইরানের ওপরে হামলা চালালো, তারপরই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বলা এই কথাগুলো থেকেই স্পষ্ট হয় যে তার দেশ এই সংঘাতে কেন জড়ালো।

ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী শান্তিপূর্ণ, অন্যদিকে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রই তৈরি করছে।

ইসরায়েলের নিজের দেশে পারমাণবিক অস্ত্র আছে কী না, সেটা কিন্তু তারা স্বীকারও করে না আবার অস্বীকারও করে না। তবে আন্তর্জাতিক মহল বিশ্বাস করে যে, তাদের কাছেও আছে পারমাণবিক অস্ত্র।

এই ধারণাটা তৈরি হয়েছে আসলে একজন মাত্র ব্যক্তির কারণে। ইসরায়েল কীভাবে গোপনে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, সেটা ওই ব্যক্তির ফাঁস করা তথ্যের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল গোটা বিশ্ব। ওই তথ্য ফাঁসের ফলে যদিও তাকে প্রায় দুই দশক জেলে থাকতে হয়েছিল।

সানডে টাইমসের প্রতিবেদন
লন্ডনের পত্রিকা দ্য সানডে টাইমস ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে একটা প্রতিবেদন ছেপেছিল, ‘রিভিলড্ – দ্য সিক্রেটস অফ ইসরায়েলস্ নিউক্লিয়ার আর্সেনাল’, অর্থাৎ ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের গোপন তথ্য ফাঁস। মনে করা হয়, এই খবরটি ব্রিটিশ সাংবাদিকতায় সবথেকে বড় ‘স্কুপ’ খবরগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা।

খবরের সূত্র ছিলেন ইসরায়েলি পরমাণু প্রকৌশলী মোরেখাই ভানূনু। অনেকেই যেটা সন্দেহ করতেন যে, ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, সেই সন্দেহের নিরসন হয় তার ফাঁস করে দেওয়া তথ্য দিয়েই।

জেরুজালেমের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে নেগেভ মরুভূমির মাঝে অবস্থিত অতি গোপন ‘ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ চাকরি করতেন ভানূনু।

তার দেওয়া তথ্যের ওপরে ভিত্তি করেই ‘দ্য সানডে টাইমস’ লিখেছিল যে, ইসরায়েল বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে এবং তাদের কাজে ২০০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে।

দ্য সানডে টাইমসের তদন্তমূলক সাংবাদিক পিটার হাউনাম বলেছিলেন, “আমরা খুব উদ্বেগে ছিলাম, ক্লান্তিও লাগছিল সবার, কেউই তো এত বড় একটা খবর এর আগে কখনও করে নি।”

তবে যে পাঁচই অক্টোবর ওই প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, সেদিনই তাদের খবরের মূল সূত্র ছিলেন যিনি, তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।

বিশ্বাসঘাতক না কি হুইসল-ব্লোয়ার?
দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক হাউনামের সঙ্গে সেবছরই অগাস্টে ভানূনুর প্রথম দেখা হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। প্রথম সাক্ষাতে ভানূনুর চেহারা দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন হাউনাম।

“প্রথম দর্শনে ভানূনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনেই হয়নি যে উনি কোনোভাবে পরমাণু বিজ্ঞানী। ছোটখাটো চেহারা, সামান্য টাক পড়েছে, দেখে খুব একটা আত্মবিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না, সাধারণ পোশাক পরা একটা মানুষ,” প্রথম দেখার কথা মনে করে বিবিসিকে বলেছিলেন হাউনাম।

তার কথায়, “তবে তিনি ডিমোনায় যা দেখেছেন, সেটা পুরো বিশ্বকে জানানোর সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন।”

তার ঠিক বছর খানেক আগে, ১৯৮৫-র শেষ দিকে ভানূনু সিদ্ধান্ত নেন যে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এশিয়া-ভ্রমণে বেরবেন। ইসরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ব্যবহার করে আর তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প – এই দুটো বিষয়ই ইসরায়েলের প্রতি তার মোহভঙ্গ ঘটিয়েছিল।

চাকরি ছাড়ার আগে অবশ্য তিনি পারমাণবিক কারখানার ভেতরে ফিল্মের দুটি রোল ভর্তি ছবি তুলে নিয়েছিলেন। সেই সব ছবির মধ্যে যেমন ছিল অস্ত্র তৈরির জন্য কীভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিষ্কাশন করা হয় , তার ছবি, তেমনই পরীক্ষাগারে বানানো থার্মোনিউক্লিয়ার যন্ত্রের একটা মডেলের ছবিও ছিল।

ভানূনুর ওই সিদ্ধান্ত তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল লন্ডনে। দ্য সানডে টাইমসের খবর ছাপা হলো, তারপরই ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ তাকে রোম থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইসরায়েলে – দীর্ঘ কারাবাসের সাজা হয় তার।

“তিনি প্রথমে বলতে শুরু করেছিলেন যে, কীভাবে তিনি কোনো ফিল্ম ছাড়াই একটা ক্যামেরা গোপনে কারখানার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে মোজার মধ্যে লুকিয়ে ফিল্ম নিয়ে ভেতরে ঢোকেন। গভীর রাতে বা খুব ভোরের দিকে তিনি গোপনে ছবি তুলতেন,” জানাচ্ছিলেন হাউনাম।

দ্য সানডে টাইমসের সম্পাদকরা হাউনামকে একটু চাপ দিচ্ছিলেন, যাতে ভানূনুকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া যায়। তার কাহিনীটা আরও যাচাই করে নিতে চাইছিলেন তারা।

তার একটা ভয় ছিলই, তবে তাও ভানূনু রাজি হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে যেতে। দ্য সানডে টাইমস তাকে রেখেছিল লন্ডনের বাইরে গ্রামের দিকে একটা ছোটখাটো হোটেলে। তবে ভানূনু বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন সেখানে। তাই তাকে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়।সেখানেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।

“একটা সপ্তাহান্তে ভানূনু যখন রাস্তায় হাঁটছিলেন, তখন তার সঙ্গে এক নারীর আলাপ হয়। দুজনে বেশ কয়েকবার দেখাও করেন। সিনেমা দেখতেও গিয়েছিলেন দুজনে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই নারীর পরিচয় সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিত তো?” বলছিলেন হাউনাম।

ভানূনু লন্ডনে যখন ছিলেন, তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে হাউনামের চিন্তা বাড়ছিল। নিয়মিত দেখা করতে যেতেন তিনি।তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে দুজনের শেষ কথোপকথনটা।

“তিনি বললেন, আমি দিন কয়েকের জন্য উত্তর ইংল্যান্ডে যাচ্ছি। আমি ঠিকই থাকব, চিন্তার কারণ নেই,” বলছিলেন মি. হাউনাম।

তিনি বলছিলেন, “আমি বলেছিলাম, যেখানেই যান না কেন দিনে দুবার করে টেলিফোন করবেন কিন্তু, যাতে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি যে আপনি নিরাপদ আছেন।”

ওই নারী ছিলেন মোসাদের গুপ্তচর
এক মাস পরে ইসরায়েল ঘোষণা করেছিল যে ভানূনুকে আটক করা হয়েছে। যেভাবে হানি-ট্র্যাপ করা হয়, অর্থাৎ নারীকে ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলার যে কায়দা, একেবারেই সেভাবে ধরা পড়েন ভানূনু। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নৌকায় করে ইসরায়েলে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

তাকে যখন ইসরায়েলের জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন যাতে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা তার অপহরণের ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে পারেন, সেজন্য হাতের তালুতে তিনি কিছু লিখে রেখেছিলেন। জানলায় সেই হাতটা চেপে ধরেছিলেন তিনি, যাতে সাংবাদিকরা ওই লেখাগুলো পড়তে পারেন।

সেভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন যে লন্ডনে পর্যটকের ভেক ধরে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো এক মোসাদ এজেন্ট শেরিল বেনতোভ।

বেনতোভই ৩০শে সেপ্টেম্বর তাকে লোভ দেখিয়ে রোমে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পরে তাকে অপহরণ করে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়।

বিশ্বাসঘাতকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে ভানূনুর বিচার শুরু হয়। তার ১৮ বছরের জেলের সাজা হয়। জেলে থাকার প্রায় অর্ধেকটা সময় তাকে একা একটা সেলে বন্দী থাকতে হয়।

জেল থেকেই দেওয়া একটি রেকর্ড করা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলাম যে আসলে কী ঘটছে। এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়। ইসরায়েলের নীতির বিপরীতে গিয়ে আমি বিশ্বকে একটা তথ্য দিতে চেয়েছিলাম।

জেল থেকে তিনি ছাড়া পান ২০০৪ সালের ২১শে এপ্রিল। তবে ইসরায়েল ছাড়ার অনুমতি তাকে কখনই দেওয়া হয় নি।মুক্তি পাওয়ার শর্ত ভঙ্গ করায় তারপরেও তাকে বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছে।

এরকমই একবার তাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ২০০৯ সালে, তখন চিৎকার করে তিনি বলেছিলেন, “১৮ বছরেও আমার কাছ থেকে কিছু বার করতে পার নি, তিন মাসেও পারবে না। ধিক্কার তোমাকে ইসরায়েল।”

ফ্রান্সের সঙ্গে গোপন চুক্তি
মোরেখাই ভানূনু তথ্য ফাঁস করার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে খুবই কম জানা ছিল। এমনকি তাদের সবথেকে কাছের মিত্র দেশগুলোও এই তথ্য জানত না।

মনে করা হয়, ১৯৪৮ সালে দেশটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল।

শত্রু দেশের সংখ্যা প্রচুর, তাই পারমাণবিক বোমা একটা নিরোধকের কাজ করবে এমনটাই পরিকল্পনা ছিল ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুর‍্যিয়নের। তবে একটা অস্থির অঞ্চলে কোনো অপ্রচলিত অস্ত্র মজুত করে তিনি ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোকেও চটাতে চান নি।

তাই ডিমোনা কারখানা গড়তে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা গোপন চুক্তি করে ইসরায়েল। ধারণা করা হয় যে পারমাণবিক বোমার জন্য উপাদান তৈরির কাজ ৬০এর দশকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। বহু বছর ধরে ইসরায়েল ওই কারখানাটিকে একটি কাপড় তৈরির কারখানা বলে প্রকাশ করতো।

যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা ওই কারখানায় ৬০-এর দশকেই একাধিকবার ঘুরে গেছেন। কিন্তু মাটির তলায় যে আরও বেশ কয়েকটি তল রয়েছে, সেটা তারা সম্ভবত বুঝতে পারেন নি। লিফট আর প্রবেশদ্বারগুলো ইটের গাঁথনি দিয়ে তারপরে প্লাস্টার করে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।

সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল আ্যন্ড নন-প্রলিফারেশনের হিসাব অনুযায়ী, এখন ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক বোমা আছে।

তবুও ইসরায়েল তার পারমাণবিক ক্ষমতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই একটা অস্পষ্টতার নীতি নিয়ে চলে। ইসরায়েলের নেতারা অনেক বছর ধরেই বারবার একটা কথা বলে আসছেন যে, “ইসরায়েল কখনই মধ্য প্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী প্রথম দেশ হয়ে উঠবে না।”

পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ ও নিরস্ত্রীকরণের ধারণা ছড়িয়ে দিতে সেই ১৯৭০ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত ১৯১ টি রাষ্ট্র ‘ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস্ বা এনপিটি-তে সই করেছে। এই চুক্তি বাংলায় পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি নামে পরিচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীন – এই পাঁচটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমোদন রয়েছে, কারণ এদের প্রত্যেকেই ১৯৬৭ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ওই চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগেই পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছিল।ইসরায়েল ওই চুক্তিতে সই করে নি।

সেদেশে ভানূনুকে বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করা হলেও ২০০৪ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তার সমর্থকরা উৎসব পালন করেছিলেন। তাকে ‘শান্তির নায়ক’ নামে ডাকা হত। মুক্তি পাওয়ার পরে তার প্রথম সাক্ষাতকারে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, তার “কোনো অনুশোচনা নেই”।

“গোপনে কী কর্মকান্ড চলছে, সেটা বিশ্বকে জানিয়েছি আমি। আমি তো বলি নি যে আমাদের উচিত ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া হোক, কিন্তু ডিমোনা ধ্বংস করা হোক। আমি শুধু তুলে ধরেছি যে, এদের কাছে কী রয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তো অন্যদের।”

সূত্র : বিবিসি।

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

যে প্রকৌশলী ফাঁস করেছিলেন ইসরায়েলি পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য

আপডেট সময় ১১:১৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

“ইরানের অস্ত্র তৈরির একেবারে কেন্দ্রস্থলে আমরা আঘাত হেনেছি,” ইসরায়েল যখন গত সপ্তাহে ইরানের ওপরে হামলা চালালো, তারপরই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বলা এই কথাগুলো থেকেই স্পষ্ট হয় যে তার দেশ এই সংঘাতে কেন জড়ালো।

ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী শান্তিপূর্ণ, অন্যদিকে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রই তৈরি করছে।

ইসরায়েলের নিজের দেশে পারমাণবিক অস্ত্র আছে কী না, সেটা কিন্তু তারা স্বীকারও করে না আবার অস্বীকারও করে না। তবে আন্তর্জাতিক মহল বিশ্বাস করে যে, তাদের কাছেও আছে পারমাণবিক অস্ত্র।

এই ধারণাটা তৈরি হয়েছে আসলে একজন মাত্র ব্যক্তির কারণে। ইসরায়েল কীভাবে গোপনে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, সেটা ওই ব্যক্তির ফাঁস করা তথ্যের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল গোটা বিশ্ব। ওই তথ্য ফাঁসের ফলে যদিও তাকে প্রায় দুই দশক জেলে থাকতে হয়েছিল।

সানডে টাইমসের প্রতিবেদন
লন্ডনের পত্রিকা দ্য সানডে টাইমস ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে একটা প্রতিবেদন ছেপেছিল, ‘রিভিলড্ – দ্য সিক্রেটস অফ ইসরায়েলস্ নিউক্লিয়ার আর্সেনাল’, অর্থাৎ ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের গোপন তথ্য ফাঁস। মনে করা হয়, এই খবরটি ব্রিটিশ সাংবাদিকতায় সবথেকে বড় ‘স্কুপ’ খবরগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা।

খবরের সূত্র ছিলেন ইসরায়েলি পরমাণু প্রকৌশলী মোরেখাই ভানূনু। অনেকেই যেটা সন্দেহ করতেন যে, ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, সেই সন্দেহের নিরসন হয় তার ফাঁস করে দেওয়া তথ্য দিয়েই।

জেরুজালেমের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে নেগেভ মরুভূমির মাঝে অবস্থিত অতি গোপন ‘ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ চাকরি করতেন ভানূনু।

তার দেওয়া তথ্যের ওপরে ভিত্তি করেই ‘দ্য সানডে টাইমস’ লিখেছিল যে, ইসরায়েল বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে এবং তাদের কাজে ২০০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে।

দ্য সানডে টাইমসের তদন্তমূলক সাংবাদিক পিটার হাউনাম বলেছিলেন, “আমরা খুব উদ্বেগে ছিলাম, ক্লান্তিও লাগছিল সবার, কেউই তো এত বড় একটা খবর এর আগে কখনও করে নি।”

তবে যে পাঁচই অক্টোবর ওই প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, সেদিনই তাদের খবরের মূল সূত্র ছিলেন যিনি, তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।

বিশ্বাসঘাতক না কি হুইসল-ব্লোয়ার?
দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক হাউনামের সঙ্গে সেবছরই অগাস্টে ভানূনুর প্রথম দেখা হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। প্রথম সাক্ষাতে ভানূনুর চেহারা দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন হাউনাম।

“প্রথম দর্শনে ভানূনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনেই হয়নি যে উনি কোনোভাবে পরমাণু বিজ্ঞানী। ছোটখাটো চেহারা, সামান্য টাক পড়েছে, দেখে খুব একটা আত্মবিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না, সাধারণ পোশাক পরা একটা মানুষ,” প্রথম দেখার কথা মনে করে বিবিসিকে বলেছিলেন হাউনাম।

তার কথায়, “তবে তিনি ডিমোনায় যা দেখেছেন, সেটা পুরো বিশ্বকে জানানোর সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন।”

তার ঠিক বছর খানেক আগে, ১৯৮৫-র শেষ দিকে ভানূনু সিদ্ধান্ত নেন যে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এশিয়া-ভ্রমণে বেরবেন। ইসরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ব্যবহার করে আর তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প – এই দুটো বিষয়ই ইসরায়েলের প্রতি তার মোহভঙ্গ ঘটিয়েছিল।

চাকরি ছাড়ার আগে অবশ্য তিনি পারমাণবিক কারখানার ভেতরে ফিল্মের দুটি রোল ভর্তি ছবি তুলে নিয়েছিলেন। সেই সব ছবির মধ্যে যেমন ছিল অস্ত্র তৈরির জন্য কীভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিষ্কাশন করা হয় , তার ছবি, তেমনই পরীক্ষাগারে বানানো থার্মোনিউক্লিয়ার যন্ত্রের একটা মডেলের ছবিও ছিল।

ভানূনুর ওই সিদ্ধান্ত তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল লন্ডনে। দ্য সানডে টাইমসের খবর ছাপা হলো, তারপরই ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ তাকে রোম থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইসরায়েলে – দীর্ঘ কারাবাসের সাজা হয় তার।

“তিনি প্রথমে বলতে শুরু করেছিলেন যে, কীভাবে তিনি কোনো ফিল্ম ছাড়াই একটা ক্যামেরা গোপনে কারখানার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে মোজার মধ্যে লুকিয়ে ফিল্ম নিয়ে ভেতরে ঢোকেন। গভীর রাতে বা খুব ভোরের দিকে তিনি গোপনে ছবি তুলতেন,” জানাচ্ছিলেন হাউনাম।

দ্য সানডে টাইমসের সম্পাদকরা হাউনামকে একটু চাপ দিচ্ছিলেন, যাতে ভানূনুকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া যায়। তার কাহিনীটা আরও যাচাই করে নিতে চাইছিলেন তারা।

তার একটা ভয় ছিলই, তবে তাও ভানূনু রাজি হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে যেতে। দ্য সানডে টাইমস তাকে রেখেছিল লন্ডনের বাইরে গ্রামের দিকে একটা ছোটখাটো হোটেলে। তবে ভানূনু বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন সেখানে। তাই তাকে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়।সেখানেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।

“একটা সপ্তাহান্তে ভানূনু যখন রাস্তায় হাঁটছিলেন, তখন তার সঙ্গে এক নারীর আলাপ হয়। দুজনে বেশ কয়েকবার দেখাও করেন। সিনেমা দেখতেও গিয়েছিলেন দুজনে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই নারীর পরিচয় সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিত তো?” বলছিলেন হাউনাম।

ভানূনু লন্ডনে যখন ছিলেন, তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে হাউনামের চিন্তা বাড়ছিল। নিয়মিত দেখা করতে যেতেন তিনি।তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে দুজনের শেষ কথোপকথনটা।

“তিনি বললেন, আমি দিন কয়েকের জন্য উত্তর ইংল্যান্ডে যাচ্ছি। আমি ঠিকই থাকব, চিন্তার কারণ নেই,” বলছিলেন মি. হাউনাম।

তিনি বলছিলেন, “আমি বলেছিলাম, যেখানেই যান না কেন দিনে দুবার করে টেলিফোন করবেন কিন্তু, যাতে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি যে আপনি নিরাপদ আছেন।”

ওই নারী ছিলেন মোসাদের গুপ্তচর
এক মাস পরে ইসরায়েল ঘোষণা করেছিল যে ভানূনুকে আটক করা হয়েছে। যেভাবে হানি-ট্র্যাপ করা হয়, অর্থাৎ নারীকে ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলার যে কায়দা, একেবারেই সেভাবে ধরা পড়েন ভানূনু। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নৌকায় করে ইসরায়েলে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

তাকে যখন ইসরায়েলের জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন যাতে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা তার অপহরণের ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে পারেন, সেজন্য হাতের তালুতে তিনি কিছু লিখে রেখেছিলেন। জানলায় সেই হাতটা চেপে ধরেছিলেন তিনি, যাতে সাংবাদিকরা ওই লেখাগুলো পড়তে পারেন।

সেভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন যে লন্ডনে পর্যটকের ভেক ধরে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো এক মোসাদ এজেন্ট শেরিল বেনতোভ।

বেনতোভই ৩০শে সেপ্টেম্বর তাকে লোভ দেখিয়ে রোমে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পরে তাকে অপহরণ করে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়।

বিশ্বাসঘাতকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে ভানূনুর বিচার শুরু হয়। তার ১৮ বছরের জেলের সাজা হয়। জেলে থাকার প্রায় অর্ধেকটা সময় তাকে একা একটা সেলে বন্দী থাকতে হয়।

জেল থেকেই দেওয়া একটি রেকর্ড করা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলাম যে আসলে কী ঘটছে। এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়। ইসরায়েলের নীতির বিপরীতে গিয়ে আমি বিশ্বকে একটা তথ্য দিতে চেয়েছিলাম।

জেল থেকে তিনি ছাড়া পান ২০০৪ সালের ২১শে এপ্রিল। তবে ইসরায়েল ছাড়ার অনুমতি তাকে কখনই দেওয়া হয় নি।মুক্তি পাওয়ার শর্ত ভঙ্গ করায় তারপরেও তাকে বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছে।

এরকমই একবার তাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ২০০৯ সালে, তখন চিৎকার করে তিনি বলেছিলেন, “১৮ বছরেও আমার কাছ থেকে কিছু বার করতে পার নি, তিন মাসেও পারবে না। ধিক্কার তোমাকে ইসরায়েল।”

ফ্রান্সের সঙ্গে গোপন চুক্তি
মোরেখাই ভানূনু তথ্য ফাঁস করার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে খুবই কম জানা ছিল। এমনকি তাদের সবথেকে কাছের মিত্র দেশগুলোও এই তথ্য জানত না।

মনে করা হয়, ১৯৪৮ সালে দেশটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল।

শত্রু দেশের সংখ্যা প্রচুর, তাই পারমাণবিক বোমা একটা নিরোধকের কাজ করবে এমনটাই পরিকল্পনা ছিল ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুর‍্যিয়নের। তবে একটা অস্থির অঞ্চলে কোনো অপ্রচলিত অস্ত্র মজুত করে তিনি ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোকেও চটাতে চান নি।

তাই ডিমোনা কারখানা গড়তে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা গোপন চুক্তি করে ইসরায়েল। ধারণা করা হয় যে পারমাণবিক বোমার জন্য উপাদান তৈরির কাজ ৬০এর দশকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। বহু বছর ধরে ইসরায়েল ওই কারখানাটিকে একটি কাপড় তৈরির কারখানা বলে প্রকাশ করতো।

যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা ওই কারখানায় ৬০-এর দশকেই একাধিকবার ঘুরে গেছেন। কিন্তু মাটির তলায় যে আরও বেশ কয়েকটি তল রয়েছে, সেটা তারা সম্ভবত বুঝতে পারেন নি। লিফট আর প্রবেশদ্বারগুলো ইটের গাঁথনি দিয়ে তারপরে প্লাস্টার করে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।

সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল আ্যন্ড নন-প্রলিফারেশনের হিসাব অনুযায়ী, এখন ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক বোমা আছে।

তবুও ইসরায়েল তার পারমাণবিক ক্ষমতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই একটা অস্পষ্টতার নীতি নিয়ে চলে। ইসরায়েলের নেতারা অনেক বছর ধরেই বারবার একটা কথা বলে আসছেন যে, “ইসরায়েল কখনই মধ্য প্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী প্রথম দেশ হয়ে উঠবে না।”

পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ ও নিরস্ত্রীকরণের ধারণা ছড়িয়ে দিতে সেই ১৯৭০ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত ১৯১ টি রাষ্ট্র ‘ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস্ বা এনপিটি-তে সই করেছে। এই চুক্তি বাংলায় পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি নামে পরিচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীন – এই পাঁচটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমোদন রয়েছে, কারণ এদের প্রত্যেকেই ১৯৬৭ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ওই চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগেই পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছিল।ইসরায়েল ওই চুক্তিতে সই করে নি।

সেদেশে ভানূনুকে বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করা হলেও ২০০৪ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তার সমর্থকরা উৎসব পালন করেছিলেন। তাকে ‘শান্তির নায়ক’ নামে ডাকা হত। মুক্তি পাওয়ার পরে তার প্রথম সাক্ষাতকারে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, তার “কোনো অনুশোচনা নেই”।

“গোপনে কী কর্মকান্ড চলছে, সেটা বিশ্বকে জানিয়েছি আমি। আমি তো বলি নি যে আমাদের উচিত ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া হোক, কিন্তু ডিমোনা ধ্বংস করা হোক। আমি শুধু তুলে ধরেছি যে, এদের কাছে কী রয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তো অন্যদের।”

সূত্র : বিবিসি।