প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে ঢাকার পিলখানায় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর (বিডিআর) সদর দপ্তরে সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞের পেছনে তৎকালীন সামরিক নেতৃত্বের ‘নিরুত্তর ভূমিকা’ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ‘গভীর ব্যর্থতা’ ছিল বলে মনে করছে জাতীয় স্বাধীন অনুসন্ধান কমিশন। কমিশন মনে করে পিলখানা হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই কমিশনের নেতৃত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমান বুধবার আজ (২৫ জুন) রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির একটি নতুন ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তৎকালীন সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা অপরাধ সংঘটনের মুহূর্তে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল।’
এ এল এম ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘ঘটনার সময়ে অপরাধ প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়িত্ব পালনে মারাত্মক অবহেলা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।’
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দুই মাস পর বিডিআরের সদর দপ্তরে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। এতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও বিষয়টি ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
ঘটনার পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বাহিনীর পোশাকেও আনা হয় পরিবর্তন।
যদিও বিদ্রোহের বিচার বিজিবির নিজস্ব আদালতে অনুষ্ঠিত হয়, তবে গণহত্যার বিচার চলে প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়, যাতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
পরবর্তী পর্যায়ে হাইকোর্টে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, ১৮৫ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আরও ২২৮ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান। হাইকোর্টে খালাস পান ২৮৩ জন।
পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটি নতুন করে অনুসন্ধানের দাবি তোলা হয় এবং বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সরকার জাতীয় স্বাধীন অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমান।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে এ এল এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক সমাধানের নামে দেরি করা এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা সেই দিনের নৃশংস ঘটনাগুলো সংঘটনের সুযোগ করে দেয়।’ তিনি দাবি করেন, ঘটনাটি সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে একে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তার ভাষায়, ‘এর আগে গঠিত দুটি অনুসন্ধান কমিটি চেষ্টা করেছে ঘটনাটিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে। জঙ্গিবাদ ইস্যুকে সামনে এনে মূল অনুসন্ধানকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে।’
বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিদেশি সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতও দেন এ এল এম ফজলুর রহমান। জানান, কিছু ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে তারা বিদেশ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু তথ্য পেয়েছেন।
তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে জানিয়ে এ এল এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য হাতে এসেছে, তাতে প্রমাণিত হয়—যদি সেই সময় সামরিক হস্তক্ষেপ হতো, তাহলে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য অপরাধ এড়ানো সম্ভব হতো।’
কমিশন এ পর্যন্ত ১৫৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আটজন রাজনীতিবিদ, যাদের মধ্যে তিনজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে কারাগারে, তিনজন সরাসরি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং বাকি দুইজন—আওয়ামী লীগের নেতা মির্জা আজম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক—বিদেশ থেকে অনলাইনে বক্তব্য দিয়েছেন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা ১৫ জন সেনা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আরও ৫০ জন কর্মকর্তা যেন লিখিত বক্তব্য দেন, সেজন্য সেনাসদর থেকে তাঁদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুটি বৈঠকে এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ আরও ৫০ জনের সাক্ষ্য এখনো বাকি আছে বলে কমিশনের সভাপতি জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, অনুসন্ধান কার্যক্রমের জটিলতা এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া বিবেচনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।