গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডরের’ বিষয়ে নীতিগত সম্মতির কথা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এমন সিদ্ধান্ত কারা, কোথায়, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কিসের ভিত্তিতে নিচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে কি-না সেই প্রশ্নও তুলেছেন। তাদের মতে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এবং একই সাথে মিয়ানমারে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারে প্রভাব আছে- এমন আঞ্চলিক সব পক্ষ একমত না হলে প্রস্তাবিত করিডরটি বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো মানবিক করিডরের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলের অনেক জায়গাই ব্যবহার করতে পারে।
আবার রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন, এমন গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে, এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছে- এমন কোনো ইঙ্গিত তারা পাননি।
প্রস্তাবিত মানবিক করিডরের ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘের হাতে থাকলেও এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকতে হবে, যাতে করে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ নিজেই তা বন্ধ করে দিতে পারে। অন্যথায় বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে না এমন কিছুও সেখানে ঘটে যেতে পারে।
মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশটির রাজধানী এখনো সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাশাপাশি আরাকান আর্মির অস্ত্রসহ অন্য রসদ সরবরাহের পথও জান্তা বাহিনী বন্ধ করে রেখেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত বছর এগারই ডিসেম্বর খবর আসে যে আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই প্রথম মিয়ানমারের পুরো একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলো কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এমন পরিস্থিতিতে তখন বিভিন্ন মহল থেকে আরাকান আর্মির সাথে সরকারের যোগাযোগ করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠে আসে।
তার আগে গত নভেম্বরেই জাতিসংঘ রাখাইনে মানবিক সংকট তীব্র হওয়ার খবর দিয়েছিলো। পরিস্থিতিকে দুর্ভিক্ষের মতো উল্লেখ করে আরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতাতেই পরে মানবিক করিডরের বিষয়টি পর্দার আড়ালের আলোচনায় উঠে আসে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।
কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে, শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ কী চেয়েছে কিংবা সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ থাকবে কি-না এসব কিছুই সরকার প্রকাশ করেনি।
বিশ্বে যুদ্ধ চলমান যেসব জায়গায় মানবিক করিডর করা হয়েছে, সেগুলোকে শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র মানবিক করিডরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি, বরং এর সঙ্গে সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডর দিলেও তাতে আদৌ রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কি-না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্য পথ বন্ধ করে রেখেছে জান্তা সরকার।
ফলে বাংলাদেশের করিডর দিয়ে যাওয়া সহায়তা আরাকান আর্মির হাতেই থাকে কি-না তা নিয়েও কৌতূহল থাকবে। আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে অথচ দেশের মানুষ, রাজনীতিক ও প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না। এসব সিদ্ধান্ত কোথায় হচ্ছে, শর্ত কী, কী হবে কেউ জানে না। সবাইকে অন্ধকারে রেখে এতো বড় সিদ্ধান্তে ঝুঁকি থেকেই যাবে। কারণ এটি জাতীয় নিরাপত্তার সাথে যুক্ত।