গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে জনগণের করের টাকার যে অপচয় হচ্ছে, সে বিষয়ে আবারও সামনে এনেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেছেন, “ফোলানোফাঁপানো প্রচার সংখ্যা দেখিয়ে জনগণের করের টাকাগুলো নিয়মিত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের ভেতরে থেকে আমরা যারা এসব মেনে নিচ্ছি, তারাও সেজন্য সমান দোষী।”
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ১৮ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের এই মন্তব্য আসে।
সরকারের কর্তাব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যক্তিসহ রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিকরা র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
খালিদী বলেন, “মান্ধাতা আমলের গণমাধ্যম নীতিমালা ও সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণ নীতির কারণে আমাদের এখনও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ সেখানে সুবিধা পাচ্ছে অসৎ প্রকাশকরা।”
চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ৫৮৪টি, যদিও এর বেশির ভাগের নাম পাঠক কখনো শোনেনি।
এসব সংবাদপত্র মিলিয়ে তাদের প্রচার সংখ্যার যে হিসাব ডিএফপিকে দেয়, তাতে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১ কোটি ৮৫ লাখ কপির বেশি পত্রিকা ছাপা হয়, যা বাস্তব সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “খবরের কাগজের প্রচার সংখ্যা নিয়ে সরকারি প্রতিবেদনগুলোর খবর যারা রাখেন, তারা জানেন যে ওই পরিসংখ্যান কতটা অবাস্তব। ওই সংখ্যাগুলোর ভিত্তিতেই সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণ এবং দর নির্ধারণ করা হয়। যুগ যুগ ধরে এমনটা চলছে। আর অনেক সংবাদপত্র মালিক নির্লজ্জের মত এই কায়দায় বিজ্ঞাপন নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর শেষ হওয়া দরকার।”
ডিএফপির নিয়ম অনুযায়ী, যেসব বাংলা দৈনিক পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার বা এর চেয়ে বেশি, সেসব পত্রিকা প্রতি কলাম–ইঞ্চি সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য ৯০০ টাকা পায়। প্রচারসংখ্যা যাদের কম, তাদের ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপনের দরও কম।
ইন্টারনেটের এই যুগেও দেশে বিজ্ঞাপন বাজারের বেশিরভাগ অর্থ যায় টেলিভিশনগুলোতে। বাকি টাকার বেশিরভাগটা পায় ছাপা পত্রিকায়। ইন্টারনেট সংবাদপত্রগুলো পায় আরো কম। আর সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংবাদপত্রগুলো আরো বঞ্চিত।
অথচ বিটিআরসির হিসাবে বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা চৌদ্দ কোটির কাছাকাছি, যা জাপানের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি, যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার দ্বিগুণ। এ থেকেই অনুমান করা যায়, অনলাইন সংবাদপত্রের মাধ্যমে কত বিশাল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “গণমাধ্যম নিয়ে আরো ভালো বোঝাপড়া এবং নীতি কাঠামো প্রয়োজন। যেমন, আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে যোগ্যতার বদলে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার এক জাজ্বল্যমান নমুনা।
“কেবল ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যেই নয়, বরং নেতৃত্বে যারা থাকেন, তাদের সামনে গঠনমূলক বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্যও বস্তুনিষ্ঠ আর স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য। তা না হলে ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণ আর বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল ধারণা এড়ানোর উপায় কর্তৃপক্ষের থাকে না।”
তবে সমস্যা যে সংবাদমাধ্যমের ভেতরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই রয়েছে, সে কথা বলতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।
তিনি বলেন, “সংবাদমাধ্যমের আত্মমর্যাদার উন্নয়ন এবং সাংবাদিকতায় নৈতিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করতে ২০১৮ সালে আমরা এডিটরস গিল্ড চালু করি। কিন্তু মুক্ত সংবাদমাধ্যমের নৈতিক বিকাশ যারা দেখতে চায় না, তাদের হস্তক্ষেপের কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সেই প্রচেষ্টা বেশিদূর এগোয়নি।