পারভেজ হোসেন ইমনের শতকে ভর করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি২০ সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুই ম্যাচের এই সিরিজের ম্যাচ জয়ের চেয়েও আলোচনায় এসেছে ইমনের এই শতক।কারণ আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটে শতক বাংলাদেশের জন্য বিরল ঘটনা।
একটি টি-টোয়েন্টি ইনিংসে ৯ টি ছক্কা যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে কেউই এর আগে পারেননি। ৫৩ বলে সেঞ্চুরি- বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত মাত্র একটি সেঞ্চুরি ছিল তামিম ইকবালের ৬০ বলে ১০০, এটি দ্বিতীয় সেঞ্চুরি এবং এটিই এখন দ্রুততম শতক।
পারভেজ হোসেন ইমনের বাড়ি নোয়াখালী হলেও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে তামিম ইকবালের শহরে তামিম ইকবালকে অনুকরণ এবং অনুসরণ করেই বড় হয়েছেন এই ওপেনার। খেলেনও তামিম ইকবালের মতই বা হাতে।
কে এই ইমন?
মাত্র নিজের অষ্টম ম্যাচেই একটা ছাপ রেখে গেলেন পারভেজ হোসেন ইমন। তবে তার এটা প্রথম টি-২০ শতক না, পারভেজ হোসেন ইমন ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেন ২০২০ সালের ৮ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে।
ফরচুন বরিশালের হয়ে মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর বিপক্ষে মাত্র ৪২ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন, যা বাংলাদেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। এই ইনিংসে তিনি ১০টি চার ও ৭টি ছক্কা মেরেছিলেন।
২০১৯ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে লিস্ট ‘এ’ ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেকের মাধ্যমে পেশাদার ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন ।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ওয়ানডে লিগ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ২০২৪ সালে ৬ ম্যাচের ব্যবধানে তিনটি সেঞ্চুরি করেছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন।
এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লীগেও ইমন ১০০ স্ট্রাইক রেট ও ৬১ গড়ে ব্যাট করে ৭৯৮ রান তোলেন। তার দল আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখেন এই তরুণ ব্যাটার।
২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইমন।তিনি ছয় ম্যাচে ৩৩.২০ গড়ে ১৬৬ রান করেন, যার মধ্যে ফাইনালে ৪৭ রানের ইনিংস ছিল উল্লেখযোগ্য ।
২০২২ সালের আগস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন ইমন। এরপর থেকে তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগসহ বিভিন্ন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছেন।
ইমনের ব্যাটিং স্টাইল আগ্রাসী ও আত্মবিশ্বাসী, যা তাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের অন্যতম সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার সাম্প্রতিক সাফল্য দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে কী বলছেন ইমন?
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতক হাঁকানোর পর ইমন নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমে, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাগছে। সেঞ্চুরি হয়েছে আজ। তাই ড্রেসিংরুমে আসার পর আমার মনে পড়েছে তামিম ভাইয়ের প্রথম সেঞ্চুরি ছিল। আমার এটা দ্বিতীয় ছিল।”
বিশেষ করে তামিম ইকবালের পরেই তার নাম এসেছে এতে ইমন খুশি। ইমন বলেন, “তামিম ভাইকে ছোট বেলা থেকে ফলো করতাম, উনার খেলা দেখতাম”।
শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলা ইমনের শতক সহজ ছিল না, বাংলাদেশের উইকেট পড়ছিল এক পাশ থেকে, তবে তাওহীদ হৃদয়ের সাথে ৫৮ রানের জুটিতে বাংলাদেশ একটা নির্ভরযোগ্য সংগ্রহের দিকে আগায়।
ইমন বলেন, উইকেট যখন পড়ছিল, তখন নিজের ইনটেন্ট না বদলানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। “আমার যে শক্তির জায়গা, সেটার জন্য সব সময় অপেক্ষা করছিলাম। তবে এটাও মাথায় ছিল যে খেলাটা বড় করতে হবে। এক প্রান্ত থেকে উইকেট পড়ছে। আমাকে ইনিংস বড় করতে হবে। তাই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত পেরেছি।” এর মাঝে ইনিংসের অষ্টম ওভারেই ৩ ছক্কা হাঁকান ইমন।
ইমনের শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা কোথায়
বাংলাদেশের সিনিয়র ক্রিকেট সাংবাদিক এম এম কায়সার বলেন, “প্রতিপক্ষ যেই হোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতক একটা আত্মবিশ্বাস জোগাবেই।”এটাকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটের একটা নতুন শুরু কথা বলছেন মি. কায়সার।
“টি২০ ক্রিকেটে রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলে ম্যাচ জেতা যাবে না, পারভেজের মধ্যে অ্যাটাকিং অ্যাপ্রোচ আছে, এই ফরম্যাটে আমি মনে করি, কেউ পাঁচ ম্যাচ খারাপ খেললেই তাকে খারিজ করে দেয়া উচিৎ না, তার সামর্থ্য আছে রান আপনি পাবেনই তার থেকে, এখানে আলাদা ব্র্যান্ডের ক্রিকেট প্রয়োজন।”
বাংলাদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হোসেইন সামির ব্যাট ধরার স্টাইল নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেন ইমনের ব্যাট ধরার স্টাইলটা প্রশংসনীয়, আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাট সুইংটা যথাযথ করার জন্য এইভাবে ব্যাট ধরার যথার্থতা প্রয়োজন।
“পারভেজ হোসেন ইমনের ব্যাট সুইং বেশ শক্তিশালী কারণ তিনি ব্যাট রাখেন দ্বিতীয় উরুর কাছে, এতে করে জোরের সাথে শট খেলতে পারেন তিনি,” নিজের বিশ্লেষণে বলেন আবিদ হোসেইন সামি।
এটাকে বাংলাদেশে টি-২০ ক্রিকেটের নতুন আসার আলো বলছেন বাংলাদেশের প্রথম বিভাগ লীগের এই ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক। কারণ বাংলাদেশে টি-২০ ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নেয়া ক্রিকেটটা সাধারণত খেলতে দেখা যায় না বলছেন সামি।একই সাথে তিনি পারভেজ হোসেন ইমনের দুর্বলতার জায়গা হিসেবে উল্লেখ করেছেন শর্ট বল খেলার অস্বস্তিকে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে এই ম্যাচের বিশ্লেষণ করে সৈয়দ আবিদ হোসেইন সামি বলেন, “আরব আমিরাতের বোলাররা পারভেজ হোসেন ইমনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি, তার যে শক্তির জায়গা ফুল লেন্থেই বল করে গেছেন তারা”।
ইমনের দুর্বলতার জায়গা শর্ট লেন্থের বল, যেখানে তেমন বল করেনি আরব আমিরাতের বোলাররা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের ধারাভাষ্যকার সামি বিপিএলে ইমনের ব্যাটিং-এর কথা মনে করিয়ে বলেন, ইমনকে পেছনের লেন্থের বল বেশ অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, তাই ইমনের এই শতকে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার জায়গা নাই বলছেন এই বিশ্লেষক।
গায়ের কাছাকাছি পেছনের লেন্থের বলে ইমনের খেলতে কষ্ট হয়, যেটা আরব আমিরাতের বোলাররা নিয়মিত বল করতে পারেননি।