নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলাম ও স্থানীয় মুসল্লিদের আপত্তিতে বন্ধ হয়ে গেছে লালন ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ নামের একটি অনুষ্ঠান। শুক্রবার ও শনিবার এই অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় এই মেলা বন্ধ হয়ে যায়।
বিবিসি বাংলা জানায়, মেলায় অংশ নিতে কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লালন ভক্তরা এই মেলায় অংশ নিতে আসলেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে ফিরে যেতে হয়েছে। গত প্রায় দশ বছর ধরে নিয়মিত এই মেলা ও অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে আসছে বলে জানান আয়োজক ফকির শাহজালাল।
শাহজালাল বলেন, হেফাজত ও এলাকার মুসল্লি কারণে এমন একটা সাধারণ অনুষ্ঠান আজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বন্ধই না, এ নিয়ে আমিও আছি হুমকির মধ্যে। অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়া হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, লালন মেলার নামে ‘অপসংস্কৃতির’ চর্চা হতো বলেই এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অনুরোধে জেলা প্রশাসক অনুষ্ঠানটি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও নারায়ণগঞ্জের নেতা আব্দুল আউয়াল বলেন, ওইখানে মেলার নাম করে মেয়েগুলোকে তারা এমনভাবে নাচায়, যেটা মেনে নেয়া যায় না। এই আয়োজনটি বন্ধের পর নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বিষয়টিকে জেলা প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এটি যদি বন্ধ করা না হতো পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যেতো।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজারে হামলা, ভাঙচুর, ঐতিহ্যবাহী মেলা বন্ধের ঘটনাও ঘটছে। একের পর এক এসব ঘটনা ঘটলে কেন প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে পারছে না প্রশাসন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুরের মধ্য নরসিংহপুর গ্রামে এক দশক ধরে নিয়মিত এই ‘মহতী সাধু সঙ্গ ও লালন মেলা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’র ব্যানারে।
এ বছরের ২২ ও ২৩ নভেম্বর অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার প্রতি বছরের মতো মেলার আয়োজনের আগে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে অনুমতি চাওয়া হয়। অন্যান্য বছরের মতো এবারও মেলা আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল মুক্তিধাম আশ্রম কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে প্যান্ডেল তৈরিসহ নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়।
আয়োজক ফকির শাহজালাল জানান, এক মাস আগে চিঠি দেয়ার পর তিনি প্যান্ডেল তৈরির কাজও এগিয়ে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ দিনের এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক ফারহানা মানিক বলেন, যদি মেলায় মাদক ও অনৈতিক কোন কাজ হয়ে থাকে তাহলে প্রশাসনের উচিত ছিল সেদিকে নজর দেয়া। কিন্তু সেটি না করে মেলাই বন্ধ করে দেয়া হলো। এটা তো কোন সমাধান না।
আয়োজক কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের অনুষ্ঠানে অনুমতি না দিয়ে প্রশাসন হেফাজতে ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করেছে। আয়োজক ফকির শাহজালাল বলেন, “শুধু অনুষ্ঠান বন্ধ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। এখন আমাকে নাস্তিক বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, সেখানে কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা এসেছিলো তাদেরকে পুলিশ এসে চলে যেতে বাধ্য করেছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
সিলেটের শাহ পরানের মাজারে ওরশ উপলক্ষে গত অগাস্টে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। গত ছয়ই সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুর এলাকায় অবস্থিত দেওয়ানবাগ মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত ২৫ অগাস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দি ইউনিয়নে আয়নাল শাহ দরগা নামে পুরোনো একটি মাজারও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে সিলেটের শাহপরাণ মাজারে তিন দিন ধরে ওরশ অনুষ্ঠানে গান বাজনা বন্ধের নির্দেশ জারি করে স্থানীয় প্রশাসন।