ঢাকা ১১:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতা হিসেবে আমি নিজেও চাপে আছি: খাদ্য উপদেষ্টা শিল্পপতি প্রেমিককে ৭ টুকরা করেন কথিত প্রেমিকা রুমা কটিয়াদীতে সেনাবাহিনীর হাতে মাদক সম্রাট আনুসহ আটক ৩ রাজনৈতিক বলয় থেকে কবে মুক্তি পাবে দুদক? মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত,কুইক রেন্টালে দায়মুক্তির বিধান অবৈধ: হাইকোর্ট গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার পরিবারের পাশে তামিম ইকবাল হাজী সেলিম পুত্রের ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ সংস্কারের গতির ওপর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্ভর করছে: প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের চায়ের আমন্ত্রণে বিএনপি নেতারা প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখা হলো না বাংলাদেশের

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক; রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
(১৬ অক্টোবর ১৯৫৬-২১ জুন ১৯৯১)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
পৃথিবীবাসের স্বল্পায়ু নিয়ে বিশে^র যে কয়েকজন কবি স্বীয় অসামান্য প্রতিভার জন্য অমর হয়ে আছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও মূলত তিনি কবি ও গীতিকার। তিনি ছিলেন তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক। মাত্র ৩৪ বছরের জীবনে বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গেছেন, তা কল্পনাতীত।

জন্ম ও শৈশব:
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম তার পিতার কর্মস্থল বরিশালে। তার পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার সাহেবের মেঠ গ্রামে। তার বাবার নাম ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। তিনি ছিলেন ১০ ভাই-বোনর মধ্যে সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল কবি রুদ্রর। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বোনের ট্র্যাংক থেকে তিনি ও তার মামাতো ভাইয়েরা মিলে টাকা ধার করেন। কথা ছিল তারা সিনেমা দেখতে যাবেন। কিন্তু সেটি না করে রুদ্র একটি লাইব্রেরি তৈরি করলেন। সেই লাইব্রেরির নাম দেয়া হয়েছিল বনফুল লাইব্রেরি। এছাড়া ছোটবেলায় রুদ্র অনেক অভিমানীও ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি তার স্কুলের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। আবার একই স্কুলের পরিচালনা পরিষদে ছিলেন তার বাবা। নিজের ছেলেকে প্রথম স্থানের পুরস্কার দেয়াটা তিনি সমীচীন মনে করেননি। তিনি ভেবেছিলেন সেটা স্বজনপ্রীতি হতে পারে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি অবশ্য অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন তার ছেলেকে। কিন্তু রুদ্র তার বাবার দেয়া সব বই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অভিমান করে।

শিক্ষাজীবন:
রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৬২ সালে নানাবাড়ি মিঠেখালি গ্রামের পাঠশালায়। ১৯৬৪ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন সাহেবের মেঠ গ্রামে তাঁর নানার নামে প্রতিষ্ঠিত “ইসমাইল মেমোরিয়াল স্কুলে”। ১৯৬৬ : মোংলা থানার “সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়” এ চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি। এ সময় পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তাঁর ঝোক দেখা যায়। এ স্কুলে পড়াকালীন নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে চার বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ।

যৌবন:
যৌবনে রুদ্র ছিলেন প্রাণবন্ত এবং কিছুটা উচ্ছন্ন। খেয়ালীপনা তার মধ্যে ছিল না। তার চুল ছিল কোঁকরা। মুখে ছিল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। জিন্স পরতেন প্রায় সময়ই। সবসময় আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অনেক মনোযোগী থাকতেন। তার এই অস্থির ভাব নিয়ে কবি শামসুল হক বলেছিলেন, “তার মধ্যে যে বাউন্ডুলেপনা ছিল তা তাকে সুস্থির হতে দেয়নি।” ১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারিতে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ১৯৮৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

কর্মজীবন:
প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত রুদ্র ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতাপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং “ভালো আছি ভালো থেকো”সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ: কবিতাগ্রন্থ : উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬), ছোবল (১৯৮৬), গল্প (১৯৮৭), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০), খুটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯১), এক গ্লাস অন্ধকার (১৯৯২)।

ছোটগল্প: সোনালি শিশির, নাট্যকাব্য: বিষ বিরিক্ষের বীজ, বড়গল্প: মনুষ্য জীবন।
পুরস্কার: মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ১৯৮০ ও ১৯৮১ এবং ২০২৪ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।
মৃত্যু : ২১ জুন শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, ঢাকার ৫৮/এফ পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা ভাষায় অসামান্য কবি রুদ্র। বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠাখালি মামার বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত হন কবি।

রুদ্র’র একগুচ্ছ কবিতা

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমোতে পারিনা-

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

 

চুয়াত্তরের প্রসব যন্ত্রনা এবং-

চিরদিন যে রমনী গভীর বিশ্বাসে
খুলে দিয়েছে শরীরের যাবতীয় পোশাক
সময়েথঅসময়ে, কালে-অকালে
বার বার মেতেছে নিষিদ্ধ অবৈধ সংগমে,
প্রতিবার এক উষ্ম প্রত্যয়ে হয়েছে অন্তসত্ত্বা ।

যে রমনী শুয়ে আছে স্নেহের অশ্লীল ভঙ্গিতে
তার তপ্ত ঘামের সোঁদা ঘ্রাণে একদিন অবক্ষয় ছেড়ে
আমি জ্বলন্ত যুবক হয়ে শুয়ে ছিলাম বিপরীতে ।

বায়ান্নর অবৈধ প্রসব তার স্বপুরুষ আজ
একাত্তরের সন্তান তার যক্ষাক্রান্ত হলো ।
সে যক্ষা একাত্তরের নয়- সে যক্ষা আমার-
সে কঠিন যক্ষা আমাদের সমস্ত শরীরে ।

বিদেশী নোতুন মডেলের দুরন্ত চাকায়
মুছে গেছে জন্মের রক্ত, কিশোরী আকাংখা ।
আমার আধগতি দেখে বন্ধুরা হাসে বলে ‘এ কেমন সন্তান হলো!’

 

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।

জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে-

আরো পড়ুন : কামিনী রায়; প্রথিতযশা বাঙালি মহিলা কবি

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক; রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আপডেট সময় ০৬:৪৯:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
(১৬ অক্টোবর ১৯৫৬-২১ জুন ১৯৯১)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
পৃথিবীবাসের স্বল্পায়ু নিয়ে বিশে^র যে কয়েকজন কবি স্বীয় অসামান্য প্রতিভার জন্য অমর হয়ে আছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও মূলত তিনি কবি ও গীতিকার। তিনি ছিলেন তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক। মাত্র ৩৪ বছরের জীবনে বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গেছেন, তা কল্পনাতীত।

জন্ম ও শৈশব:
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম তার পিতার কর্মস্থল বরিশালে। তার পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার সাহেবের মেঠ গ্রামে। তার বাবার নাম ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। তিনি ছিলেন ১০ ভাই-বোনর মধ্যে সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল কবি রুদ্রর। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বোনের ট্র্যাংক থেকে তিনি ও তার মামাতো ভাইয়েরা মিলে টাকা ধার করেন। কথা ছিল তারা সিনেমা দেখতে যাবেন। কিন্তু সেটি না করে রুদ্র একটি লাইব্রেরি তৈরি করলেন। সেই লাইব্রেরির নাম দেয়া হয়েছিল বনফুল লাইব্রেরি। এছাড়া ছোটবেলায় রুদ্র অনেক অভিমানীও ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি তার স্কুলের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। আবার একই স্কুলের পরিচালনা পরিষদে ছিলেন তার বাবা। নিজের ছেলেকে প্রথম স্থানের পুরস্কার দেয়াটা তিনি সমীচীন মনে করেননি। তিনি ভেবেছিলেন সেটা স্বজনপ্রীতি হতে পারে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি অবশ্য অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন তার ছেলেকে। কিন্তু রুদ্র তার বাবার দেয়া সব বই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অভিমান করে।

শিক্ষাজীবন:
রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৬২ সালে নানাবাড়ি মিঠেখালি গ্রামের পাঠশালায়। ১৯৬৪ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন সাহেবের মেঠ গ্রামে তাঁর নানার নামে প্রতিষ্ঠিত “ইসমাইল মেমোরিয়াল স্কুলে”। ১৯৬৬ : মোংলা থানার “সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়” এ চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি। এ সময় পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তাঁর ঝোক দেখা যায়। এ স্কুলে পড়াকালীন নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে চার বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ।

যৌবন:
যৌবনে রুদ্র ছিলেন প্রাণবন্ত এবং কিছুটা উচ্ছন্ন। খেয়ালীপনা তার মধ্যে ছিল না। তার চুল ছিল কোঁকরা। মুখে ছিল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। জিন্স পরতেন প্রায় সময়ই। সবসময় আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অনেক মনোযোগী থাকতেন। তার এই অস্থির ভাব নিয়ে কবি শামসুল হক বলেছিলেন, “তার মধ্যে যে বাউন্ডুলেপনা ছিল তা তাকে সুস্থির হতে দেয়নি।” ১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারিতে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ১৯৮৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

কর্মজীবন:
প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত রুদ্র ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতাপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং “ভালো আছি ভালো থেকো”সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ: কবিতাগ্রন্থ : উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬), ছোবল (১৯৮৬), গল্প (১৯৮৭), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০), খুটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯১), এক গ্লাস অন্ধকার (১৯৯২)।

ছোটগল্প: সোনালি শিশির, নাট্যকাব্য: বিষ বিরিক্ষের বীজ, বড়গল্প: মনুষ্য জীবন।
পুরস্কার: মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ১৯৮০ ও ১৯৮১ এবং ২০২৪ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।
মৃত্যু : ২১ জুন শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, ঢাকার ৫৮/এফ পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা ভাষায় অসামান্য কবি রুদ্র। বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠাখালি মামার বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত হন কবি।

রুদ্র’র একগুচ্ছ কবিতা

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমোতে পারিনা-

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

 

চুয়াত্তরের প্রসব যন্ত্রনা এবং-

চিরদিন যে রমনী গভীর বিশ্বাসে
খুলে দিয়েছে শরীরের যাবতীয় পোশাক
সময়েথঅসময়ে, কালে-অকালে
বার বার মেতেছে নিষিদ্ধ অবৈধ সংগমে,
প্রতিবার এক উষ্ম প্রত্যয়ে হয়েছে অন্তসত্ত্বা ।

যে রমনী শুয়ে আছে স্নেহের অশ্লীল ভঙ্গিতে
তার তপ্ত ঘামের সোঁদা ঘ্রাণে একদিন অবক্ষয় ছেড়ে
আমি জ্বলন্ত যুবক হয়ে শুয়ে ছিলাম বিপরীতে ।

বায়ান্নর অবৈধ প্রসব তার স্বপুরুষ আজ
একাত্তরের সন্তান তার যক্ষাক্রান্ত হলো ।
সে যক্ষা একাত্তরের নয়- সে যক্ষা আমার-
সে কঠিন যক্ষা আমাদের সমস্ত শরীরে ।

বিদেশী নোতুন মডেলের দুরন্ত চাকায়
মুছে গেছে জন্মের রক্ত, কিশোরী আকাংখা ।
আমার আধগতি দেখে বন্ধুরা হাসে বলে ‘এ কেমন সন্তান হলো!’

 

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।

জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে-

আরো পড়ুন : কামিনী রায়; প্রথিতযশা বাঙালি মহিলা কবি