ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের চরম অনিয়ম দুর্নীতিতে ধ্বংস হয়ে যায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার নোয়াগাঁও এলাকায় অবস্থিত দেশে ফরমালিন তৈরীর একমাত্র কারখানা ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ। একপর্যায়ে এসে ইন্ডাস্ট্রিজের মেশিনারী যন্ত্রপাতিও স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রী করে দেয়। যা এখন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এই মিলটির ১০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যবান যন্ত্রপাতি মাত্র ১.৯ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির টেন্ডার আহ্বানে কোন নিয়মনীতি পর্যন্ত মানা হয়নি। গুটি কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজশে এত কম দামে মেশিনারী যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।
এর পেছনে কলকাঠি নাড়িয়েছেন রাঙ্গুনিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তারই ইচ্ছায় পটিয়া উপজেলার বাসিন্দার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সজীব এন্টারপ্রাইজ এ কাজের টেন্ডার ভাগিয়ে নেয়। তবে ক্ষমতা পালাবদলের পর রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির একাংশের কতিপয় নেতা ভাগাভাগি করে মিলের মালামালগুলো সরিয়ে নিচ্ছে।
বিষয়টি স্বীকার করে স্থানীয় পৌর বিএনপি নেতা মো. সেকান্দর বলেন, টেন্ডারটি আওয়ামী লীগ আমলের। এ সময় রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার শামসু, পৌর কাউন্সিলর জালাল, হাছান মাহমুদের ক্যাশিয়ার এমরুল করিম রাশেদ ও কায়ছারের দখলে ছিল টেন্ডারের কাজ। গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাবার পর কাজটা আমরা নিয়েছি। আমরা সবাই মিলে যৌথভাবে কাজটি করছি।
কিন্তু টেন্ডারটি পেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরের সাগরিকাস্থ সজীব এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা তার কাছ থেকে সরফভাটার ইসমাইলসহ ৫০% কাজ নিয়েছি। আমাদের সাথে বিএনপির শতাধিককর্মী জড়িত। ৫০% কাজের মধ্যে থেকে বেতাগী ইউনিয়নে ১০%, পোমরায় ১০%, নোয়াগাঁওয়ে ১০%, নিজে ১০% ও ইসমাইল ১০% করে আমাদের মধ্যে ভাগ হয়েছে। তবে ইসমাইল বিদেশে। তার কর্মীরা কাজে যুক্ত থেকে দেখা শুনা করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মিলের ভেতরে বিশাল আকৃতির ট্যাংক, বয়লার, বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সপাওয়ার, গ্যাসসিলিন্ডার, ভারি ইস্পাত-লোহার পাতসহ সকল বিভাগের মেশিনারী যন্ত্রপাতি বড় বড় ট্রাকে করে লোডিং আর আউটিংয়ের কাজ করছে। কড়া প্রহরা দিয়ে মিলের মুল গেইট বন্ধ রেখে দিবারাত্রি চলছে মালামাল সরিয়ে ফেলার মহাযজ্ঞ। প্রতিদিন ৪-৫ ট্রাক মালামাল দেদারসে পাচার হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাগরিকায় সজীব এন্টাপ্রাইজের ডিপোতে এই মালামাল সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাওয়ালি গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত মিলটি ১৯৭৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছিল। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার নোয়াগাঁও এলাকায় ১০ দশমিক এক একর ভূমির উপর এই শিল্প প্রতিষ্টানের পাশে রয়েছে নিজস্ব আরও ১৫ একর পাহাড়ি ভূমি। দেশের একমাত্র ফরমালিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্টান ছিল এই ইস্টার্ন কেমিক্যাল। এটি বিদেশ থেকে মিথানল আমদানি করে উন্নতমানের ফরমালিন উৎপাদন করত।
২০১৭ সালেও গড়ে মাসিক উৎপাদিত মালামাল বিক্রি করে এ মিল মাসিক ২২ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল। তাছাড়া চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকায় ইস্টার্ন কেমিক্যালের ১৯ ও ২৪ শতাংশের ২টি প্লট আছে। একটি ডেভেলপার কোম্পানীর মাধ্যমে ১৯ ও ২৯ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কোম্পানি থেকে জামানত হিসেবে প্রাপ্ত ১৫ কোটি টাকার ফান্ড রয়েছে। ব্যাংক থেকে সে টাকায় ৮ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পাচ্ছেন এই ট্রাস্ট।
এই মিলটি বন্ধ করতে ব্যাক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি সিন্ডিকেট চক্র। মিথানল আমদানি বন্ধ করে দেন চক্রটি। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে লোকসান শিল্প দেখাতে উচ্চ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার ইন্ধনের কথা সরাসরি প্রকাশ্যে চলে আসে। এ চক্রের মাধ্যমে কিছু দিন প্যারা ফরমালিন বাহির থেকে আমদানি করে ইউরিয়া ফর্মালডিহাইড এডহেসিভ, ইউরিয়া ফর্মালডিহাইভ কম্পাউন্ডে পাউডার ইউনিট ২টি চালু রাখে।
এই সিন্ডিকেট চক্রের যোগসাজসে ২০১৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনতে শুরু করে। ২০১৬ সালে যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয় তাহা শেষ করা হয় ক্রমাগত লোকসান দেখিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ জুন অবশেষে বন্ধ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। অন্য ৯টি প্রতিষ্ঠানের মতো সেবছর জুলাই মাসে দরপত্র আহ্বান করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে ইস্টার্ন কেমিক্যালের প্রধান ও উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হারুন ২০১৮ সালের ২১ জুন স্বাক্ষরিত এবং ৩০ জুন মিল বন্ধের ঘোষণার প্রেক্ষিতে কার্যকর হলেও পরবর্তীতে নিলামের অর্ডারটি বাতিল হয়। কিন্তু সেই অসাধু কর্তাদের দৌড়ঝাপ বন্ধ হয়নি। ট্রাস্টের উচ্চ পর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট সভা করে পুনরায় ২০১৮ সালের ৩০ জুনের রূপরেখায় হাটা শুরু করে। এ বিষয়ে বহু তদবিরের পর সেই ফলাফলের লক্ষ্যে পৌছে যায় সিন্ডিকেট চক্রটি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী হাছান মাহমুদের সহযোগিতায় তার গুণধর নেতা ইঞ্জিনিয়ার শামসু-এমরুল করিম রাশেদ ও কায়ছারদের হাত দিয়ে শুরু হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। যদিও চট্টগ্রাম সাগরিকাস্থ সজীব এন্টারপ্রাইজের ব্যানারে ৩১ জুলাই ২০২৪ সে টেন্ডার পুনরায় করা হয়। কিন্তু ৫ আগষ্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের হোমরা চোমরারা পালিয়ে গেলে তা সহজে প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়।
এক সময়ে চাকুরি করা ইস্টার্ন কেমিক্যালের এক শ্রমিক জানায়, এই মিলের টেন্ডার হাওয়া মালামালের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকার উপরে। কেন বা কারা এত অল্প টাকায় কিনে নিল তা ভাবতে অবাক লাগে। মিলের ট্রান্সমিটার ও ২টি গাড়ি রয়েছে যা সম্পূর্ণ নতুন। রয়েছে আড়াই কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। মিলের ১০ একর জমি ছাড়াও আরো রয়েছে মিলের ১৫ একর পাহাড় ভূমি। মিলের যন্ত্রপাতি ও কাচাঁমাল বিক্রি না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে মিলটি চালু করা হলে যেমনি মানুষের কর্মসংস্থান হতো তেমনি সরকারের লাভজনক শিল্প প্রতিষ্টান হিসেবে পুনরায় উজ্জীবিত হতো বেশি। এই মিল বন্ধের কারনে ৪ জন কর্মকর্তা, ২৪ জন কর্মচারী ১২ জন শ্রমিক ও ৫০ জন অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় শতাধিক পরিবারের শান্তি চিরদিনের জন্য ফুরিয়ে গেল।
সাইড এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিনিধি রুহুল আমীনের কাছে জানতে চাইলে এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে মিলের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রির টেন্ডার আহ্বানে কোন নিয়মনীতি মানা হয়নি। খোজাখুজি করে কোন সুনিদিষ্ট কাগজপত্র শিল্প মন্ত্রনালয়েও পাওয়া যায়নি। সকল নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়েছে। গুটি কয়েক কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে এত কম দামে মেশিনারী যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে তাহা খোদ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত জানে না।
রাঙ্গুনিয়ায় চলাচলের রাস্তা বন্ধ, প্রতিবাদ করায় মারধর, বিপাকে দুই অসহায় পরিবার